মিরাজ তথা নূরের চলন্ত সিঁড়িযোগে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ, সপ্তাকাশ পরিভ্রমণ, সৃষ্টিজগতের রহস্য অবলোকন, জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন ও আল্লাহর দরবারে মহামিলন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুজিজা। পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তন্মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ শবে মিরাজের স্থান সর্ব শীর্ষে। মহানবী (সা.) যখন জাগতিক ও পারিপার্শ্বিক অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হন, পিতৃব্য আবু তালিব ও বিবি খাদিজা (রা.)-এর আকস্মিক ইন্তেকাল হয়, অন্যদিকে কাফেরদের অত্যাচার তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে; তখন মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা স্বীয় হাবিবকে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে এনে সান্ত্বনা দিয়ে আদর্শ সমাজ সংস্কারের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। পবিত্র কোরআনে একাধিক সূরায় মিরাজের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর নৈশকালীন সফরের বিষয়টি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘পবিত্র ও মহিমান্বিত তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে (মুহাম্মদ) এক রজনীতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছিলাম তাকে আমার নিদর্শন পরিদর্শন করার জন্য।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)
নবী করিম (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সে মাক্কি জীবনের শেষলগ্নে অর্থাৎ নবুয়তের দশম বছরে রজব মাসের ২৭ তারিখ মিরাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়। আল্লাহর নির্দেশে গভীর রাতে জিবরাইল (আ.), মিকাইল (আ.) ও ইসরাফিল (আ.)—এই তিন ফেরেশতা নবীজির সান্নিধ্যে আগমন করে তাঁকে কাবা শরিফের হাতিমে নিয়ে আসেন এবং অতঃপর ঐশীবাহন ‘বোরাক’কে উপস্থিত করে এতে আরোহণ করার জন্য জিবরাইল (আ.) ইঙ্গিত করেন। তিনি বোরাকে আরোহণ করলে সেটি ত্বরিতগতিতে মদিনা মুনাওয়ারা, সিনাই পর্বত, হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান ‘বায়তে লাহম’ হয়ে চোখের পলকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছাল। নবীকুল শিরোমণি সেখানে আম্বিয়ায়ে কিরামের সঙ্গে জামাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। তিনি হলেন ‘ইমামুল মুরসালিন’ অর্থাৎ সব নবী-রাসুলের ইমাম। নৈশভ্রমণের প্রথমাংশ এখানেই সমাপ্ত হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পরিভ্রমণকে ‘ইস্রা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
তারপর নবী করিম (সা.) বোরাকে আরোহণ করলে তা দ্রুতগতিতে মিরাজ বা ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণ শুরু করে। এ সময় বিশ্বস্রষ্টার নভোমণ্ডলের অপরূপ দৃশ্যাবলি দেখে তিনি বিমোহিত হন। প্রথম আকাশে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আকাশে হজরত ঈসা (আ.) ও হজরত ইয়াহ্ইয়া (আ.), তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আকাশে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আকাশে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে নবী করিম (সা.)-এর সাক্ষাৎ হলে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সপ্তম আসমানে অবস্থিত ‘বায়তুল মামুরে’ তিনি অসংখ্য ফেরেশতাকে তাওয়াফরত অবস্থায় অনেককে সালাত আদায় করতেও দেখেন। এরপর তিনি জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে বেহেশত-দোজখ পরিদর্শন করেন। মিরাজকালে মহানবী (সা.) সৃষ্টিজগতের সবকিছুর রহস্য অবলোকন করেন এবং আল্লাহর অসীম কুদরতের যাবতীয় নিদর্শন দেখেন। তিনি আল্লাহর বিধিবিধান, ভাগ্যলিপি অবিরাম লিখে চলেছে যে কলম, সেটাকেও লিখনরত অবস্থায় দেখতে পান। এ ছাড়া আলমে বারজাখের অসংখ্য দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকন করে পুনরায় সিদরাতুল মুনতাহায় ফিরে আসেন।
সপ্তম আসমান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত এসে তিনি জিবরাইল (আ.)-কে স্বরূপে দেখতে পান। এখানে তাঁর বাহনও পরিবর্তন হয়। একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের কুদরতি বাহন ‘রফরফ’ এসে হাজির হয়। নবী করিম (সা.) ‘রফরফে’ আরোহণ করে কল্পনাতীত দ্রুতবেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মোয়াল্লার সন্নিকটে পৌঁছালেন এবং আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন। তিনি স্থান-কালের ঊর্ধ্বে লা মাকাম-লা জামান স্তরে পৌঁছান। নূর আর নূরের সৌরভে তিনি অভিভূত হয়ে যান। সেখানে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দিদার হয় এবং কথোপকথন হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর নৈকট্য, সান্নিধ্য ও দিদার লাভ করার পর জ্ঞান-গরিমায় মহীয়ান হয়ে তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন এবং করুণা ও শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ মিরাজ রজনীর উপহার হিসেবে আল্লাহর বান্দাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ওই রাত ও উষার সন্ধিক্ষণে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সাহাবিদের কাছে আদ্যোপান্ত ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন সাহাবায়ে কিরাম আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে ‘আমরাও যদি মিরাজ গমন করতাম!’ এ সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, ‘নামাজ মুমিনদের জন্য মিরাজস্বরূপ।’ (ইবনে মাজা) তাই মহানবী (সা.)-এর বিস্ময়কর মুজিজাকে উপলব্ধি বা হৃদয়ঙ্গম করে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অবশ্যকর্তব্য।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।